ডিজিটাল ডেস্ক, ২০ এপ্রিল: শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং বস্তি—এই চারটি গণসংগঠনের উদ্যোগে রবিবার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সমাবেশ আয়োজন করে সিপিএম। এপ্রিলের তীব্র গরম মাথায় রেখে সভা শুরু হয় দুপুর ৩টেয়। মঞ্চে ছিলেন মোট ছ’জন বক্তা। সভার শেষ বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম রবিবার ব্রিগেড সমাবেশে বলেন, “যাঁরা দূরবীন দিয়েও লাল ঝান্ডা দেখতে পাচ্ছিলেন না, আজকের এই ব্রিগেড তাঁদের বুক কাঁপিয়ে দেবে। আজ দেশে কাজের সুযোগ কমছে, কেন্দ্র ও রাজ্য—কোনও জায়গাতেই নিয়োগ হচ্ছে না। আর যেখানে নিয়োগ হচ্ছে, সেখানে দুর্নীতির পাহাড়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছে—২৬ হাজার চাকরি বাতিল হয়ে গিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যেখানে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াবে, সেখানেই পুলিশকে মামলা করতে হবে। না হলে আমরা নিজেরা রাজ্যের প্রতিটি থানায় এফআইআর করব। লাল ঝান্ডা কোনও সাধারণ কাপড় নয়, এটা চিটফান্ডের টাকায় কেনা হয়নি।” গরম নিয়ে উদ্বেগ প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, “অনেকে ভাবছিলেন, এত রোদের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ কীভাবে মাঠে আসবেন। কিন্তু প্রকৃতিও আমাদের পাশে ছিল—তপ্ত রোদ ওঠেনি।”
মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমি শমসেরগঞ্জ, সুতি ঘুরে এসেছি। কোথাও পুলিশের গুলিতে, কোথাও হামলাকারীদের আক্রমণে প্রাণ গেছে। আমি সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে তাঁদের কাছে পৌঁছেছি।” শেষে সেলিমের বার্তা ছিল, “দেশকে বাঁচাতে হলে লাল ঝান্ডাকে আবার শক্ত করতে হবে।”
ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে বন্যা টুডুকে নিয়ে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, “লড়াইয়ের ময়দান থেকেই উঠে এসেছে বন্যা। আমাদের নেতানেত্রী টালিগঞ্জ বা বলিউড থেকে আসেন না, তাঁরা শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। ক্রিকেটের ভাষায় ও বলেছে—উইকেট ফেলে দেব। আর সেটা করতে হলে ফুটবলের ভাষায় বলতে হয়—নেমে খেলতে হবে। যাতে দুর্নীতিবাজদের চোদ্দ তলা থেকে টেনে মাটিতে নামানো যায়।”
ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গ টেনে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, “দুর্নীতিবাজদের চোদ্দ তলা থেকে মাটিতে নামানোর শপথ নিতে হবে আমাদের। গরিব মানুষের লড়াই লাটসাহেবদের দিয়ে হয় না—স্যুট-বুট পরে কেউ এই লড়াই লড়তে পারবে না। গরিবকেই নামতে হবে ময়দানে। বাঁচতে হলে হিন্দু-মুসলমানকে একসঙ্গে লড়তে হবে।”
তিনি স্পষ্ট করে দেন, “আমরা লড়াইকে ভয় পাই না। কিন্তু সেই লড়াই মন্দির বা মসজিদ ঘিরে নয়। ধর্মের নামে যারা ব্যবসা করে, তাদের দিকে চোখ রাখা জরুরি। বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখুন—আমরা মুর্শিদাবাদকে সেই পথ চলতে দেব না। সংখ্যালঘু নিধনের জমি হতে দেব না এই রাজ্যকে। তাই এখনই শপথ নিতে হবে—আমাদের লড়াই হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, মা-বোনের নিরাপত্তা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য।”
তৃণমূল ও বিজেপিকে একযোগে আক্রমণ করে সেলিম বলেন, “বাংলাকে তৃণমূল-বিজেপির হাতে সর্বনাশ হতে দেব না। সব ধর্মের অধিকার রক্ষা করে সরকার চালাতে হবে, এটাই আমাদের দাবি। অথচ এখন সরকারই মন্দির-মসজিদ চালাতে চাইছে! আগে বরং ট্রেনটা ঠিকঠাক চালাক। কেন্দ্র ট্রেন বেচে দিচ্ছে, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার ট্রাম বিক্রি করছেন। আসলে তৃণমূল আর বিজেপি—দুই দলের স্ক্রিপ্টই এক। আর সেই স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছে নাগপুরে, মোহন ভাগবতের হাতে।”
সেলিম আরও বলেন, “ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে গোটা দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন না শুধু বিজেপি আর তৃণমূলের পাঁচ-ছ’জন সাংসদ ছাড়া। তবু অন্য কোথাও অশান্তি হয়নি, তাহলে মুর্শিদাবাদেই বা হল কেন? সেখানে যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। আমরা চাই, এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত হোক—কে ষড়যন্ত্র করেছে, কারা ছিল নেপথ্যে, সব সামনে আসুক।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “বলা হচ্ছে, অশান্তির পেছনে বহিরাগতদের হাত আছে। কিন্তু তারা এল কোথা থেকে? ভিতরে ঢুকল কী ভাবে?”
এরপর হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে সেলিম বলেন, “হিন্দু আর মুসলমান একে অপরের বিরুদ্ধে নয়, লড়াই করতে হবে বেকারত্বের বিরুদ্ধে। ২০২৬-এর লড়াইয়ের সূচনা হোক এখান থেকেই। এই লড়াইকে গ্রামে গ্রামে, মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।”
প্রসঙ্গত রবিবার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং বস্তি—এই চারটি গণসংগঠনের উদ্যোগে সিপিএমের পক্ষ থেকে আয়োজিত হয় বিশাল জনসমাবেশ। এপ্রিলের রোদ মাথায় রেখে সভা শুরু হয় দুপুর ৩টেয়। মঞ্চে ছিলেন মোট ছয়জন বক্তা। রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ছাড়াও বক্তাদের তালিকায় ছিলেন কৃষকসভার অমল হালদার, ক্ষেতমজুর সংগঠনের নিরাপদ সর্দার, বস্তি উন্নয়ন সমিতির সুখরঞ্জন দে, সিটুর অনাদি সাহু এবং বাম যুব নেত্রী বন্যা টুডু।
বক্তারা প্রত্যেকেই মেহনতি মানুষের অধিকার, বেকারত্ব, দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তোলেন। বারবার উঠে আসে ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা। সমাবেশে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠেন বন্যা টুডু। তাঁর ভাষণের সরলতা ও আঞ্চলিক টান বাম কর্মী-সমর্থকদের মন ছুঁয়ে যায়। অন্য বক্তারাও পিছিয়ে থাকেননি। অমল হালদার, অনাদি সাহু এবং সুখরঞ্জন দে সমাজের প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমণ শানান। নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতিকে এক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলে কটাক্ষ করেন তাঁরা।
Comments are closed.