বাংলার রাজনীতিতে হুগলী আর বাম এই দুটোই যেন সমার্থক শব্দ হয়ে গিয়েছিল এক সময়। ১৯৫৭ সাল থেকে শুরু টানা ২০০৯ অবধি এই আসনে কায়েম ছিল বাম রাজত্ব। মাঝে খালি একবার ১৯৮৪ সালে বিরতি ছিল ৫ বছরের। সেই বছর সারা দেশের প্রব্ল কংগ্রেস হাওয়ায় গা ভাসিয়েছিল গঙ্গা পাড়ের এই জেলাও। তার মধ্যে রূপচাঁদ পাল সাংসদ হয়েছেন ৭ বার। এই লোকসভা কেন্দ্রেই রয়েছে সিঙ্গুর বিধানসভাও। ২০০৪ অবধি বামেদের বিজয় রথ ছুটলেও মমতার ঐতিহাসিক সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের পরে ২০০৯ সালে ঘাসফুল ফোটে এই আসনে। ৮০ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয় তৃণমূলের রত্না দে নাগ। ২০১৪ সালে সেই ব্যবধান আরও বাড়িয়ে ২লাখের বেশি ভোটে জেতেন তৃণমূল প্রার্থী রত্না। তবে সেই শেষ। ২০১৯ সালে ঘটি উল্টোয়। যে আসনে ২০১৪ সালে ২ লাখের বেশি ব্যবধানে জয় পেয়েছিল তৃণমূল সেই আসনে ৭৩ হাজারের বেশি ভোটে পদ্ম ফোটান অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়। এই বারেও এই আসনে প্রার্থী তিনিই। আশাবাদী নিজের জয় নিয়েও।
তৃণমূল বড় চমক দিয়েছে হুগলীতে। হারানো আসন ফিরে পেতে প্রার্থী করেছে এক সময়ে লকেটের সহকর্মী পর্দার ‘দিদি নম্বর ১’ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রার্থী হিসাবে রচনার নাম ঘোষণার কিছুদিন আগেই তাঁর রিয়্যালিটি শোতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জল্পনা তখন থেকেই ছিল, তবে তাঁকে কোন আসনে প্রার্থী করা হবে সেই নিয়েই ছিল ধন্দ। অবশেষে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে লকেটের বিরুদ্ধে হুগলীতে রচনাকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল।
রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় এক কালে বাংলার ১ নম্বর নায়িকাদের তালিকায় থাকলেও কালের নিয়মে কমে তাঁর যশ। তবে সেসব অতিক্রম করে ‘দিদি নম্বর ১’ রিয়্যালিটি শো এর মাধ্যমে আবারও বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। এখন তাঁর জনপ্রিয়তাকেই কাজে লাগাতে তৎপর তৃণমূল। কিন্তু প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই নিজের নানা মন্তব্যের জেরে বার বার বিতর্কের মুখে পড়েছেন রচনা। এমনকি সমাজমাধ্যমে ট্রোলের স্বীকার হয়েছেন রচনা।
উলটোদিকে এখন রুপালি পর্দা থেকে অনেকটা দূরে লকেট পুরোদস্তুর রাজনীতিক। বিজেপির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাংগাঠনিক পদেও রয়েছেন তিনি। রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের রাজনীতিতেও কখনও সামনের সাড়িতে দেখা যায় তাঁকে। রচনার মন্তব্য এবং তাঁর ব্যস্ততাকে নিশানা করে লকেটের দাবি ভোটে জিতলেও রুপালি জগত ছেড়ে মানুষের কাজে সময় দেবেন না রচনা। উলটোদিকে তৃণমূলের হাতিয়ার লকেটকে নিয়ে দলের মধ্যেই অসন্তোষ। এমনকি তাঁকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করা নাও হয়ে পারে বলে শোনা গিয়েছিল এক সময়।
এই আসনে বামেদের প্রার্থী মনোদীপ ঘোষ। দুই তারকার মাঝে যেন একটু ম্লান একসময়ে সিপিএমের সংগঠনের বড় দায়িত্ব সামলানো মনোদীপ। আবার গত লোকসভার ভোট শতাংশ খুব একটা আশাজনক নয় তাঁদের জন্য। ২০১৯ লোকসভা ভোটের অঙ্ক বলছে সিপিএমের ঝুলিতে ছিল ১১.১৪% ভোট, আর তাদের জোট সঙ্গী কংগ্রেসের ঝুলিতে ছিল মাত্র ১.৭৬% ভোট। অন্যদিকে বিজেপির লকেট পেয়েছিলেন ৪৬.৪৯% ভোট আর তৃণমূল পেয়েছিল ৪১.৪১% ভোট। সেই ভোটে ৭ বিধানসভার পাঁচটিতে জয় পেয়েছিল বিজেপি। যদিও তারপর ২০২১ সালে অনেকটাই বদলে গিয়েছে হুগলীর হিসাব। কারণ বিধানসভা ভোটে ৭টিতেই জয়ী হয় তৃণমূল। তবে সে যাই হোক লড়াই যে আদপে দুই ফুলেই তা খানিকটা মেনেই নিচ্ছেন রাজনীতির কারবারিরা। এখন কোন নায়িকাকে বেছে নেয় হুগলীবাসী সেটাই দেখার।