LokSabha Election 2024: ‘রাম নামে’ই ভোট জিততে চায় পদ্ম এবং ঘাসফুল! বামের আশা হারানো সমর্থন, নজরে মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র
‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী’ ক্ষ্মতার লড়াইয়ে এই প্রবাদ বহু পুরনো। সেই প্রবাদকেই হাতিয়ার করে ভোটের ময়দানে নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলি। ভোটের আবহে প্রথম দিন থেকেই খবরে মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র। কারণ এই আসনের বিদায়ী সাংসদ। তিনি হলেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ২০১৯ সালে তিনিই প্রার্থী হয়েছিলেন মেদিনীপুরে। মেদিনীপুর তো বটেই, তাঁর নেতৃত্বে আরও ১৭ আসনে রাজ্যে পদ্ম ফুটেছিল সেই বার। কিন্তু তারপর ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে লজ্জাজনক হারের পরে সেই পদ খোয়াতে হয়েছে দিলীপকে। সময়ের সঙ্গে দলের মধ্যে কমেছে তাঁর গুরুত্বও। এই বার লোকসভা ভোটে প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পাল।
স্বাধীনতার পর থেকে মূলত কংগ্রেস রাজ দেখেছে মেদিনীপুর। মাঝে একবার ভারতীয় জন সঙ্ঘ এবং ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের জনতা পার্টি জয় পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বাম শাসন। প্রথম দু’বার জয়ী হন নারায়ণ চৌবে। ১৯৮৯ থেকে ৫ বার সাংসদ হন ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। সাংসদ থাকার সময়ে কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎ। তবে তাঁর মৃত্যুর পরে ২০০১ সালে উপনির্বাচনে জিতে সাংসদ হন বামেদের প্রবোধ পান্ডা। ২০০৯ সালে প্রবল মমতা হাওয়ায় জেতেন তিনি।
তবে ২০১৪ সালে বাম রাজত্বে যবনিকা পতন হয়। ১ লক্ষ ৮৬ হাজার ভোটে জয়ী হন তৃণমূলের প্রার্থী সন্ধ্যা রায়। মমতা নিজের ক্যারিশ্মায় জিতিয়ে নিয়ে আসেন সন্ধ্যা রায়কে। তবে ২০১৯ সালে আর ভোটে দাঁড়াননি তিনি।
বরং ২০১৯ সালে প্রাত্থী করা হয় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে আসা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মানস ভুঁইয়াকে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মেদিনীপুরে পদ্ম ফোটান তৎকালীন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ৮৯ হাজার ভোটে পরাজিত হন মানস। এখন তিনি তাঁর গড় সবং এর বিধায়ক।
তবে প্রথম পদ্ম ২০১৯ সালে ফুটলেও মেদিনীপুরে রাম ভক্তের সংখ্যা যে নেহাত কম নয় তা ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়। কারণ যেখানে রাজ্যের অধিকাংশ আসনে ২০০৯ সাল অবধি প্রায় কোনও অস্তিত্ব ছিল না বিজেপির সেখানে মেদিনীপুরে বহুবার মূল বিরোধী হয়ে উঠেছে গেরুয়া শিবির। শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। সেই বার ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মূল নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বিজেপির মনোরঞ্জন দত্ত। যদিও ভোটের শতাংশে ৩০% পিছিয়ে ছিল বিজেপি। এরপর ১৯৯৯ সালে ৪৫ শতাংশ ভোট পান মনোরঞ্জন কিন্তু জয় আসেনি। ২০০৪ সালে অবশ্য সেই ভোট খানিকটা কমে। তখন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। ঝুলিতে আসে ৩৫% ভোট। তারপর ২০০৯ সালে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায় গেরুয়া শিবির। ভোট কমে হয় ৪%। ২০১৪ লোকসভায় তা ১০ শতাংশ বেড়ে হয় ১৪%। এরপর চমক দেন দিলীপ। এতদিন যেই আসন বিজেপির কাছে ছিল ‘তাঁকে ধরব ধরব করছি, তবু ধরতে পারছি না’ সেই আসনেই পদ্ম ফোটান ঘোষ বাবু।
২০১৯ ভোটে বিজেপি পায় ৪৮.৬২% ভোট। তৃণমূল পায় ৪২.৩১% ভোট। অন্যদিকে ততদিনে নিজেদের গৌরব হারিয়ে বামেদের ঝুলিতে ৪.৪২% ভোট। আর কংগ্রেসের অবস্থা আরও শোচনীয়, জোটে মাত্র ১.৪৮% ভোট।
এই বার লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী করেছে অভিনেত্রী জুন মালিয়াকে। ২০২২ সালে মেদিনীপুর বিধানসভায় জিতে বিধায়ক তিনি। বিজেপি প্রার্থী করেছে অগ্নিমিত্রা পালকে। ২০২১ অবশ্য তাঁকে আসানসোলের উপনির্বাচনে শত্রুঘ্ন সিনহার কাছে হারতে হয়েছিল বড় ব্যবধানে। বামেরা প্রার্থী করেছে বিপ্লব ভট্টকে। যদিও রাজনীতির কারবারিদের মতে মেদিনীপুরে যুযুধান দুই ফুল। কারণ এখন বামেদের কাছে সম্বল বলতে সিপিআই আর কংগ্রেসের ভোট মিলিয়ে সর্ব সাকুল্যে ৫ শতাংশ। যদিও বামদের দাবি ২০১৯ রামে যাওয়া ভোট ফিরবে।
তবে মেদিনীপুরে রাম ভরসা তা মানেন তৃণমূলীরাও। তাই তো ভোটের আগে রামস্তুতিতে মন দিয়েছিলেন জুন মালিয়াও। কংসাবতী নদীর পারে তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার সাহয্যে তৈরি হয়েছে রাম-সীতা-হনুমান মন্দির। মকর সংক্রান্তির দিনে রাম মন্দিরের উদ্বোধন করেন জুন মালিয়া। অযোধ্যার সরযূর মতো কাঁসাইয়ের পারেও করা হয় আরতি।
যদিও অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনের এই ভোটে বিশেষ প্রভাব ফেলবে ধারণা রাজনৈতিক মহলের একাংশের। রামনবমী পালনেও জোর দিয়েছে তৃণমূল বিজেপি দুই শিবির। পদ্ম শিবিরের মুখে ছিল ‘জয় শ্রীরাম’। ঘাসফুল শিবির বলেছে, ‘জয় সীতারাম’ স্লোগান। সেই সঙ্গে শান দিয়েছে মহিলাবিরোধী অস্ত্রে। শাসক দলের কটাক্ষ বিজেপি মহিলা বিরোধী তাই কোনদিন ‘জয় সীতারাম’ বলেনা।
রাম ভোট থাকলেও মেদিনীপুরে রয়েছে আদি এবং নব্য বিজেপির দ্বন্দ্ব। জুন মালিয়ার নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণার পরে তাঁকে দু’লক্ষ ভোটে হারানোর কথা বলেছিলেন দিলীপ ঘোষ। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কারণ তাঁকে আর এই কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়নি। নিয়ে যাওয়া হয়েছে বর্ধমান-দূর্গাপুরে। আর অগিমিত্রা পালের নাম মেদিনীপুরের প্রার্থি হিসাবে ঘোষণার পরেই তিনি গিয়েছিলেন অধিকারী বাড়িতে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি দিলীপকে প্রার্থী না করার পিছনে নাকি শুভেন্দু অধিকারীর হাত রয়েছে। যদিও সেই দ্বন্দ্ব সামনে আনতে তৎপর দুই পক্ষ। দিলীপের বক্তব্য, ‘মেদিনীপুরের মাটি তৈরিই রয়েছে। আমি সেটা করে রেখেছি। মানুষ ভোট দেবেন মোদীজিকে দেখে।’ আর অগ্নিমিত্রা বলেন, ‘দিলীপদার আশীর্বাদ নিয়েই এসেছি। তিনিই আমায় মহিলা মোর্চার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।’
ভোটের অঙ্ক একটু জটিল এই কেন্দ্রে। কারণ ২০১৯ ভোটে দিলীপ ঘোষকে এগিয়ে রেখেছিল ৬টি বিধানসভা। তৃণমূল এগিয়েছিল কেবল খড়্গপুরে। কিন্তু ২০২১ সালে সেই হিসাব বদলে যায়। খড়্গপুর সদরে জয় পায় বিজেপি, বাকি ৬ আসনে জয়ী হয় তৃণমূল। এখন প্রশ্ন দিলীপের ছেড়ে আসা মেদিনীপুর ধরে রাখতে পারবেন তো অগ্নিমিত্রা নাকি আবারও ঘাসফুল ফোটাবে জুন মালিয়া।