LokSabha Election 2024: বঙ্গোপসাগরের তীরে এগিয়ে ঘাসফুল, নোনা জলে কি পদ্ম ফুটবে, কী বলছে ভোটের সমীকরণ
গোসাবা, বাসন্তী, কুলতলি, জয়নগর, ক্যানিং পশ্চিম, ক্যানিং পূর্ব এবং মগরাহাট পূর্ব এই সাত বিধানসভা আসন নিয়েই তৈরি জয়নগর লোকসভা কেন্দ্র। বিধানসভা আসনগুলির দিকে নজর দিলেও বোঝা যায় সাগরের ধার বরাবর বিস্মৃতি জয়নগর লোকসভার। বঙ্গোপসাগর, নোনা জল আর চাষীদের জয়নগর।
স্বাধীনতার পরে ক্ষমতা ছিল কংগ্রেসের হাতে। তবে প্রথম বাঁধা পড়ে ১৯৬৭ সালে। ভারতবর্ষের আরেক কমিউনিস্ট পার্টি এসইউসিআই বা সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া। বাংলার এই কেন্দ্রে বরাবর একটু বেশি শক্তিশালী তাঁরা। রাজ্যে অন্য কোনও আসনে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে খাতা খুলতে না পারলেও জয়নগরে জয়ী হয়েছে দু’বার। প্রথমবার ১৯৬৭ সালে, কংগ্রেসকে হারিয়ে সাংসদ হন চিত্ত রায়। তবে পরের বার আবার আসন পুনরুদ্ধার করে কংগ্রেস। ১৯৭১ সাংসদ শক্তিকুমার সরকার। ১৯৭৭ সালেও তিনিই জেতেন এই কেন্দ্রে, তবে কংগ্রেসের টিকিটে নয়, ভোটে লড়েন মোরারজি দেশাইয়ের জনতা পার্টির হয়ে। এর পর টানা ৮ বারের বাম রাজত্ব। পর পর আটবার এই কেন্দ্র থেকে সংসদে গিয়েছিলেন আরএসপি নেতা সনৎকুমার মন্ডল।
তবে বামফ্রন্ট জমানার শেষ হয় ২০০৯ সালে। তৃণমূল এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে আবার জয় পায় এসইউসিআই। সাংসদ হন তরুণ মন্ডল। ৪৮ শতাংশ ভফত পেয়েছিলেন তরুণ। সেই ভোটে অবশ্য সনৎকুমারকে আর প্রার্থী করেনি আরএসপি, বদলে নিমাই বর্মণ ভোটে ল্রে পেয়েছিলেন ৪২ শতাংশ ভোট। বিজেপি তখন ২% ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে।
এরপর ২০১১ সালে পালা বদল হয় রাজ্যে। ততদিনে এসইউসিআইয়ের সঙ্গে জোট ভেঙে গিয়েছে ঘাস শিবিরের। ২০১৪ সালে প্রতিমা মন্ডলকে প্রার্থী করে তৃণমূল। ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন তিনি। ব্যবধান এক লাখের বেশি। ৩২% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন আরএসপির সুভাষ নস্কর। গতবারের বিদায়ী সাংসদ এসইউসিআইয়ের তরুণ মন্ডল ৯.৯০% ভোট পেয়ে চলে যান তৃতীয় স্থানে। বিজেপি চারে থাকলেও সামান্য ভোট বেড়ে হয় ৯.৫৪%। অন্যদিকে কংগ্রেস তখন ৫ নম্বরে, ঝুলিতে ভোট ৩%।
২০১৯ সালেও তৃণমূল প্রার্থী করে প্রতিমা মন্ডলকে। ৪১ থেকে ভোট বেড়ে হয় ৫৬ শতাংশ। জয়ের ব্যবধান বেড়ে হয় ৩ লাখ ১৬ হাজার। তবে দ্বিতীয় স্থানে আরএসপি এবং এসইউসিআইকে টপকে চলে আসে বিজেপি। পেয়েছিল ৩৩ শতাংশ ভোট।
এই ভোটেও বিদায়ী সাংসদ প্রতিমা মন্ডলকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থী করেছে অশোক কান্ডারিকে। জোট সমর্থিত আরএসপি প্রার্থী সমরেন্দ্রনাথ মন্ডল। প্রার্থী দিয়েছে এসইউসিআই, লড়ছেন নিরঞ্জন নস্কর। যদিও ভোটের অঙ্কে অনেকটাই এগিয়ে তৃণমূল। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে ৭টি বিধানসভা থেকেই লিড পেয়েছিলেন প্রাক্তন ডব্লুবিসিএস অফিসার প্রতিমা মণ্ডল। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনেও ফলাফল এক পেশে। সেই ভোটে সাতে সাত পায় তৃণমূল।
তবে এই আসনে জয়ের পিছনে আর একজনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে আসা শওকত মোল্লা। অনুব্রত মন্ডল বা অর্জুন সিংহের মতো পুরোটা না হলেও রাজ্য রাজনীতিতে ক্যানিং পূর্বের বিধায়কের ছবি খানিকটা বাহুবলি নেতার। সিপিএম জমানায় শুরু তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের। সেই সময় ক্যানিং ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তিনি। তখন থেকেই বঙ্গোপসাগরের তীরে তাঁর দাপট। রাজনৈতিক হিংসা এবং ত্রাস নাকি তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। বাম জমানায় বার বার বিরোধীদের রক্তে লাল হয়েছে এই লোকসভা। বিশেষত নিয়ম করে কংগ্রেস এবং তৃণমূল পেটানোর পিছনে অনেকেই দায়ী করেন শওকাতকে। আবার উলটো হাওয়া রয়েছে। ক্যানিং পূর্বে ১৯৭৭ থেকে ২০১১ অবধি টানা বিধায়ক হয়েছেন সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লা। পালা বদলের পরে অবশ্য তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। সেই সময়ে ভেড়ি দখল করে কেন্দ্র করে বোমাবাজি, গুলি চলা ছিল এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ২০১৬ সালে রেজ্জাককে ভাঙরে সরিয়ে ক্যানিং পূর্বে শওকতকে প্রার্থী করে তৃণমূল। আসরে নেমেই রেজ্জাকের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ তিনি যে ভাব সামাল দিয়েছিলেন তা নজর এড়ায়নি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের। অল্প দিনেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। বাম আমলে রেজ্জাক মোল্লাকে এবং তারপর দল পালটে তৃণমূলের আমলে জেলায় ঘাসফুলকে জেতানোর পিছনে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করে না কোনও দলই। এই বারেও নিজের দলের গোষ্ঠী কোন্দল মিটিয়ে প্রতিমা মন্ডলকে জেতানোর জন্য তাঁর উপরেই আস্থা রাখছে দল। সুতরাং প্রার্থী যেই হোক না কেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজনীতিতে পদ্ম শিবিরের জন্য বড় কাঁটা হতে পারেন শওকত মোল্লা।
তবে শওকতের বাহুবলি স্বত্বাকে হাতিয়ার করে প্রচারের ময়দানে নেমেছে বিরোধী শিবির। তাঁদের দাবি ঐ এলাকায় কোনও গণতন্ত্র নেই। পঞ্চায়েতে ভোটে ব্যপক ভোট লুট হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। আবার রাস্তা-ঘাট বানানো থেকে ১০০ দিনের কাজ প্রভুত সরকারি প্রকল্পের টাকা লুট হয়েছে বলেও অভিযোগ সিপিএম-বিজেপির। এই কেন্দ্রের ৩৬ শতাংশ ভোট সংখ্যালঘু। তাই সেই দিক থেকে দেখলেও হাওয়া খানিকটা ঘাস শিবিরেই। তবে প্রার্থী দিয়েছে নওসাদ সিদ্দিকির দল আইএসএফও। এখন বাম-এসইউসিআই-আইএসএফ কার কতটা ভোট কাটবে তাঁর উপরে নির্ভর করছে এই ভোটে শিকে ছিঁড়বে কার!