LokSabha Election 2024:ডায়মন্ড হারবারে কি হ্যাট্রিক করবেন অভিষেক, নাকি ঘটতে পারে ১৯৮৪র ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
ডায়মণ্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্র, রাজ্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলির মধ্যে একটি দক্ষিণ ২৪ পরগণার এই কেন্দ্র। মূলত গ্রামীণ এলাকা নিয়ে তৈরি। ডায়মন্ড হারবার, বজবজ, মেটিয়াবুরুজ, বিষ্ণুপুর, ফলতা, সাতগাছিয়া এবং মহেশতলা এই সাত বিধানসভা নিয়ে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে ভোটের অঙ্ক অনেকটা কেকেআর বনাম সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের ফাইনাল ম্যাচের মতোই এক পেশে। পাল্লা ঝুঁকে শাসক দলের দিকেই। কারণ ঘাসফুলের প্রার্থী স্বয়ং তৃণমূল সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সাল থেকেই এই কেন্দ্রের সাংসদ তিনি। এই বার জিতলে হ্যাট্রিক করবেন অভিষেক। অবশ্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ‘যদি’র কোনও জায়গা নেই, জিতবেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকই।
যদিও আজ বামেদের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে, কিন্তু এক সময় এই কেন্দ্রই ছিল বামেদের শক্ত ঘাঁটি। যেখানে স্বাধীনতার পরে রাজ্যের প্রায় সব কেন্দ্রেই প্রথম জয় পেয়েছিল কংগ্রেস সেখানে ১৯৫২ সালেই ডায়মন্ড হারবারে জয় পায় বামেরা। সাংসদ হয়েছিলেন সিপিআই নেতা কমল বসু। তবে কিছুদিন পরেই অবশ্য বামপন্থা থেকে দক্ষিণ পন্থায় ফিরে আসে কিছুদিনের মধ্যেই। পরপর দুবার সাংসদ হন কংগ্রেসের পুর্নেন্দুশেখর নস্কর। তারপর আবার জয়ী হন বামেদের কাঁসারি হালদার। ১৯৬২ সালে পুনরায় জয়ী হন জাতীয় কংগ্রেসের সুধাংশু ভূষণ দাস।
এর পর ১৯৬৭ সালে পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠা পায় বাম রাজত্ব। টানা ১২ বার লোকসভা ভোটে জয় পায় বামেরা। জ্যোতির্ম্য় বসু, অমল দত্ত এবং শমিক লাহিড়ী প্রত্যেকে চার বার করে জয়ী হন এই আসনে। ডায়মন্ড হারবারে প্রথম ঘাসফুল ফোটে ২০০৯ সালে। বাম প্রার্থী শমীক লাহিড়ীকে হারিয়ে জয়ী হন প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা তথা তৎকালীন তৃণমূল নেতা অধুনা প্রয়াত সোমেন মিত্র।
তবে প্রথমবার ২০০৯ সালে জয় পেলেও ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের টক্কর সেই ১৯৯৮ সাল থেকেই। ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের হয়ে ভোটে লড়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন কাকলি ঘোষ দস্তিদার, পেয়েছিলেন ৩৯% ভোট। এরপর ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসা সর্দার আমজাদ আলিকে প্রার্থী করে তৃণমূল। এর আগে ১৯৯৬ সালেও এই আসনে কংগ্রেসের হয়ে প্রার্থী হয়ে ৪৪% ভোট পেয়েছিলেন আমজাদ। কিন্তু ১৯৯৯ সালে সেই ভোট কমে দাঁড়ায় ৩৯ শতাংশে। ২০০৪ সালে তৃণমূল প্রার্থী করে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সৌগত রায়কে। কিন্তু তৃণমূলের ভোট কমে হয় ৩৩%। বাম প্রার্থী শমীকের জেতার ব্যবধান আগের থেকেও বাড়ে। তবে সেই শেষ, ২০০৯ সালে ঘাসফুল ফোটান সোমেন মিত্র। দেড় লাখের বেশি ব্যবধানে জয় পান তিনি। ঝুলিতে আসে ৫৩ শতাংশ ভোট। বামেদের শমীক লাহিড়ী পান ৩৯ শতাংশ ভোট। সেই বারে প্রথম বিজেপির হয়ে প্রার্থী হন অভিজিৎ দাস। পকেটে আসে মাত্র ২.৮৮% ভোট।
২০১৪ সালে তৃণমূলের হয়ে ডায়মন্ড হারবারে টিকিট দেওয়া হয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ভোট কমে প্রায় ১৩ শতাংশ। ঝুলিতে আসে ৪০ শতাংশ ভোট। তবে ৭১ হাজার ভোটে জয়ী হন তিনি। দ্বিতীয় স্থানে বাম প্রার্থী আবুল হাসনাত ৩৪% ভোট পান। বিজেপির হয়ে আবারও প্রার্থী করা হয় অভিজিৎ দাসকে। প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট বেড়ে হয় ১৫.৯২%।
২০১৯ সালে আবার তৃণমূলের টিকিতে প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ততদিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপোর পরিচয় থেকে বেরিয়ে সাংসদ হিসাবে নিজের পরিচিতি তৈরি করে ফেলেছেন অভিষেক। বেড়েছে জনপ্রিয়তাও। সারা বছর নিজের কেন্দ্রের মানুষের জন্য খুলেছেন হেল্প লাইন নম্বর, তৈরি করেছেন ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাব, শীতকালে আয়োজন করেন বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নিজের কেন্দ্রে ৭ বিধানসভা নিয়ে আয়োজন করেন ‘এমপি কাপ’ ফুটবল প্রতিযোগিতার। এই সব কিছু মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে নিজের জায়গা পাকা করেছেন অভিষেক। নিজের কেন্দ্রকে ‘মডেল’ লোকসভা কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে ব্রতী তিনি। আর এই সবের বিনিময়ে ২০১৯ সালে সাড়ে তিন লক্ষ ভোটে জয়ী হন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে দ্বিতীয় স্থানে বামের বদলে বিপক্ষ হয়ে উঠে আসে বিজেপি। সেই বার অবশ্য আর অভিজিৎ দাসকে নয়, বরং নীলাঞ্জন দাশগুপ্তকে প্রার্থী করেছিল গেরুয়া শিবির। ঝুলিতে আসে ৩৩% ভোট। আর অভিষেক পান ৫৬% ভোট। বামেদের ভোট কমে দাঁড়ায় ৬.৭৮% এবং কংগ্রেস পায় ১.৪৩% ভোট।
এই বারে অভিষেকের বিরুদ্ধে আবার ভূমিপুত্র তথা সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ অভিজিৎ দাসকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। তার আগে অবশ্য অভিষেকের বিরুদ্ধে কাকে প্রার্থী করা হবে তা নিয়ে জল্পনা কম হয়নি। প্রায় সব আসনে প্রার্থী ঘোষণার পরে ১১ দফায় অভিজিতের নাম ঘোষণা করা হয়। এলাকায় যিনি বেশি পরিচিত ববি নামে। কানাঘুষোয় শোনা যায় অভিষেকের বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে নাকি রাজি হননি কোনও বড় নেতাই। অগত্যা অভিজিতেই গতি।
বামেরা প্রার্থী করেছে তরুণ নেতা প্রতীক-উর-রহমানকে। ইতিহাসের ছাত্র প্রতিক ছাত্র ফেডারশনের রাজ্য সভাপতি এবং সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য।
তবে নিজের জয় নিয়ে এক প্রকার নিশ্চিত অভিষেক তথা তৃণমূল। ভোটের অঙ্কের দিকে তাকালে তাও ঘাসফুলের জন্য বেশ স্বস্তিজনক। কারণ ২০১৯ সালে জয়ের সময় সবকটি বিধানসভা আসন থেকেই লিড বেড়েছিল। আবার ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও সাতে সাত পেয়েছে তৃণমূল।
অভিষেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস আর দুর্নীতিকেই হাতিয়ার করেছে বিরোধীরা। বিজেপি প্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণার পরে অভিজিৎ-এর দাবি, ডায়মন্ড হারবারে তাঁর জয় নিশ্চিত, কারণ তিনি সেখানকার ‘ভূমিপুত্র’, আর অভিষেক ‘বহিরাগত’। তৃণমূল সেনাপতিকে ‘পেপার টাইগার’ বা ‘মিডিয়ার বাঘ’ বলেও কটাক্ষ করেছিলেন অভিজিৎ। ইডি সিবিআইয়ের একাধিকবার তলব এবং অভিষেকের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগকে হাতিয়ার করেছে বাম-রাম দুই শিবির। অভিষেকের ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’কেও কটাক্ষ করে বিরোধীদের দাবি, ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’ মানেই খুন, ভোট লুট আর সন্ত্রাস।
এই আসনে বামেদের প্রার্থীর কিছুটা পরিচিতি থাকলেও, বিজেপি প্রার্থী সেই তুলনায় একটু হালকা। তবে গেরুয়া শিবির তা মানতে নারাজ। অন্যদিকে সেপ্টেম্বর মাস থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্নীতি নিয়ে সুর চড়িয়ে ডায়মন্ড হারবারে নিজের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন আইএসএফ বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকি। শেষ মূহুর্তে দলের অনিচ্ছার কথা জানিয়ে সরে দাড়ান তিনিও। প্রার্থী করা হয়েছে মজনু লস্করকে। তাই সব দিক থেকে মিলিয়ে দেখলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় নিয়ে একরকম নিশ্চিত ঘাসফুল শিবির। মানুষের মন হিসাব মানে না। ইতিহাস বলছে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের শুরুটা ছিল খানিকটা বেহিসাবি। যাদবপুর কেন্দ্রে ১৯৮৪ সালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে যে ২৯ বছরের মমতা সাংসদ হবেন তা কল্পনাও করতে পারেননি অনেকেই। তাই সেই রকম কিছু ডায়মন্ড হারবারেও হবে কিনা তা উত্তর পাওয়া যাবে ৪ জুন।