LokSabha Election 2024: শাল-মহুয়ার জঙ্গলমহলে পুনরায় ঘাসফুল ফুটবে নাকি ঝাড়গ্রামে ফের জিতবে পদ্ম শিবির
একদিকে কংসাবতী, অন্যদিকে সুবর্ণরেখা। তারই মাঝে সাবুইঘাস আর কেন্দুপাতার জঙ্গলমহল। সেই জঙ্গলমহলেই রয়েছে ঝাড়গ্রাম। রয়েছে ডুলুং নদীও। তবে জঙ্গলমহলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ঠিক যতটা মনোরম ততটাই জটিল এখানকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবন। আর তাই ভোটের অঙ্ক কষা আরও কঠিন।
স্বাধীনতার পরে দেড় দশক এখানে বজায় ছিল কংগ্রেস রাজ। দু’বার জাতীয় কংগ্রেস এবং একবার বাংলা কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল ঝাড়গ্রামে। কিন্তু তারপরেই কায়েম হয় বাম রাজত্ব। প্রান্তিক মানুষের জঙ্গলমহলে ‘সর্বহারারা’ থাকবে না তা কখনও হয়। ১৯৭৭ সালে জয়ী হন যদুনাথ কিস্কু, সেই শুরু বাম শাসনের। এরপর ১৯৮০ থেকে টানা চার বার সাংসদ হন মতিলাল হাঁসদা। ১৯৯১ থেকে ২০০৪ অবধি বামেদের পক্ষ থেকে ৫ বার ভোটে লড়েন রূপচাঁদ মুর্মু। আর ২০০৯ সালে দল প্রার্থী করে পুলীন বিহারী বাস্কেকে। সেই শেষ বার জয় পেয়েছিল বামেরা। তখনও সেই আসনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেসের অমৃত হাঁসদা। তবে বাম প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তিন লাখ ভোটে।
এরপর ২০১৪ সালে লালগড় জঙ্গলমহলে শাল, মহুয়ার বোনের মাঝেই ঘাসফুল ফোটায় শাসক দল। তৃণমূল প্রার্থী উমা সরেন সেই ভোটে পান প্রায় ৫৫ শতাংশ ভোট। আর বামেদের পুলীবিহারীর ভোট কমে দাঁড়ায় ২৬ শতাংশে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ভোটে বাম প্রার্থীকে পরাজিত করেন উমা। বিজেপির বিকাশ মান্ডি তখন ৯.৭৪% ভোট পেয়ে তিন নম্বরে। আর কংগ্রেসের ঝুলিতে মাত্র ৩.২২% ভোট।
কিন্তু পাঁচ বছর যেতে না যেতেই আবার পালাবদল। বিজেপি প্রার্থী কুনার হেমব্রম মদী হাওয়ায় ঘাসফুলের বদলে পদ্ম চাষ করে ঝাড়গ্রামে। ২০১৯ সালে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন বীরবাহা সোরেন। সেই ভোটে বীরবাহাকে ১১ হাজার ভোটে পরাজিত করেন কুনার। বিজেপির ভোট ৩৫ শতাংশ বেড়ে হয় ৪৪.৫৬% এবং তৃণমূল পায় ৪৩.৭২% ভোট। অন্যদিকে বামেদের ভোট কমে হয় ৫.৩৮%। কংগ্রেস পায় ১.৪৮% ভোট।
তবে এই বার বিদায়ী সাংসদকে প্রার্থী করেনি বিজেপি। আর সেই কথা আগে বুঝতে পেরেই পদ্ম ছেড়ে ঘাস শিবিরে যোগ দিয়েছেন কুনার। বিজেপি প্রার্থী করেছে চিকিৎসক প্রণত টুডুকে। দীর্ঘদিন ধরে ঝাড়গ্রাম হাসপাতালের চিকিৎসক তিনি। সেই সূত্রেই এলাকায় বেশ পরিচিতি রয়েছে। যদিও রাজনীতির আঙিনায় এই প্রথম।
তৃণমূলের প্রার্থী প্রখ্যাত নাট্যকার কালীপদ সোরেন। বিশেষ করে সাঁওতালি সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সাঁওতালি সাহিত্যের ‘খেরওয়াল সোরেন’ ২০২২ সালে পদ্ম সরকারের কাছ থেকেই পেয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার। সক্রিয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি এই ভোটেই। তবু আদিবাসী সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই জঙ্গলমহলে আবার ঘাসফুল দেখতে চাইছে রাজ্যের শাসক শিবির।
জোট সমর্থিত সিপিআইএম প্রার্থী সোনামণি মুর্মু। নিজে সরাসরি রাজনীতি না করলেও, দাদু ছিলেন সিপিএম কর্মী। ঘোর বাম জমানায় এই অঞ্চলে ছিল মাওবাদীদের দাপট। তাই তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলাদা। সেই সময় একাধিক বার রক্তে ভেসেছে ঝাড়গ্রামের বিনপুর, শালবনি, বান্দোয়ান। মাওবাদীদের দাপট ছিল লালগড়েও। কেন্দুপাতা এবং সাবুই ঘাসের ন্যায্য দামের দাবি নিয়ে ছিল তাঁদের লড়াই। সিপিএম রাজ অটুট থাকলেও, মাওবাদীদের হাতে দিনের পর দিন অত্যাচারিত হয়েছে বামেদের কর্মীরা। সেই রকম এক সিপিএম কর্মী ছিলেন সোনামণির দাদু। স্বামী মণিশ টুডু বান্দোয়ানের কুমড়া পঞ্চায়েতের কর্মী। সেই অর্থে প্রান্তিক পরিবারের গৃহবধূ সোনামণিই এই বার বামেদের প্রার্থী।
কেন্দুপাতা আর সাবুই ঘাসের ন্যায্য দামের মতোই জঙ্গলমহলের ভোটের নিজস্ব ইস্যু রয়েছে। তাঁর মধ্যে একটি হল হাতির সমস্যা। মাঝে মাঝেই জঙ্গলের সীমানা ছাড়িয়ে হাতির পাল ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। হাতির আঘাতে প্রাণ হারাতে হয় স্থানীয়দেরও। তবে তার জন্য রাজ্য সরকার থেকে এককালীন ৫ লাখ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এই একই সমস্যার জন্য ওড়িশা ও কেরল সরকার দেয় ৬ এবং ১০ লাখ টাকা। আর একেই হাতিয়ার করে প্রচারে নেমেছে পদ্ম এবং বাম শিবির। তাঁদের দাবি হাতির আগমন রোখার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেয় না রাজ্য সরকার। যদিও সেই দাবি উড়িয়ে শাসক দলের কথা কেউ হাতির কারণে মারা গেলে কেবল ৫লাখ টাকা দেওয়া ন্য সঙ্গে পরিবারের এক ব্যাক্তিকে সরকারি চাকরি দেয় তৃণমূল। যা কেরল বা ওড়িশার কোথাও হয় না।
আবার মোদীর আমলে আদিবাসী মহিলা দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে বিজেপি একটু এগিয়ে আছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের একাংশ। উলটো দিকে রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরির দ্রৌপদী সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের পরে আদিবাসী ভোটের হাওয়া নিজের পালে টানা আরও সুবিধা পদ্ম শিবিরের জন্য। যদিও তৃণমূল প্রার্থীর আবার জঙ্গলমহলের আসিবাসী সমাজে এক ভাল প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূলের আশা ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের ফল। ২০১৯ লোকসভা ভোটে পাঁচ বিধানসভায় হারলেও ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে সাতে সাত পেয়েছে শাসক শিবির। সেই অঙ্কে খানিকটা সুবিধা ঘাসফুল শিবিরের। তবে আদপে কোন অঙ্কে কে জিতবে তা বোঝা যাবে ৪ জুন।