সাত রঙা বিহুর আনন্দে মাতোয়ারা অসম, এখানে এই সময়ে গরুকেও জানাতে হয় নববর্ষের শুভেচ্ছা, লিখছেন সপ্তমী দাস
সকাল থেকেই কানে ভেসে আসছে একটা গান। বসন্তের এই সময়ে যখন বাঙালিরা মেতে ওঠে নববর্ষের আগমনে, ঠিক তেমনি অহম অঞ্চলের মানুষও মেতে ওঠে বিহুর আনন্দে। বাঙালিদের মতোই অসমিয়াদের এই সময়ে নববর্ষের সূচনা। ‘বহাগ বিহু’ অথবা ‘রঙালী বিহু’ বলে পরিচিত এই উৎসবের আবেগ যেন অন্য মাত্রায় থাকে। জানলার পাশ দিয়ে দূরে চোখ যায় দীর্ঘ জলাশয়ে। যেখানে লোকজন গরু নিয়ে নেমেছে গো-বিহুর আচার পালনে। আসলে অসমের গ্ৰাম্য এলাকার কৃষীজীবিরা সকালে গরুকে নদী অথবা পুকুরে নিয়ে গিয়ে শরীরে তেল মাখিয়ে মাসকালাই-হলুদ দিয়ে স্নান করায়। নানা ধরনের ফল-সবজি গরুকে খাওয়ানো হয়। সঙ্গে গেয়ে ওঠে-
লাউ খা বেগেনা খা, বসরে বসরে বাঢ়ি যা
মার হরু বাপের হরু, তই হবি বর গরু
— যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়— লাউ-খা. বেগুন খা, বছরে বছরে আয়তনে বেড়ে যা/ মার ছোট, বাবার ছোট– তুই হয়ে যাবি বড়় গরু।
গরু বিহুর জন্যে ব্যবহার করা হয় ছাত এবং মাখিয়তী দিঘলতী নামে গাছের পাতা। এই সময় শিশু, মহিলা, পুরুষ সবাই পুকুর পারে একসঙ্গে গরু বিহু উদযাপন করে। আর গা-ধোয়ানোর পর্বে সবাই মিলে একসঙ্গে গেয়ে ওঠে-
দীঘলতির দীঘল পাত, গরু কুবাওঁ জাত-জাত
মাখিয়তীর মাখি পাত, মাখি মারোঁ জাত-জাত
— এর বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—- দীঘলতির বড় পাতা, গরুকে পাতা দিয়ে স্পর্শ করে বল জাত-জাত/ মখিয়তীর মাখি পাতা দিয়ে স্পর্শ করে বল মাখি মারো জাত-জাত
স্নান পর্ব শেষে সেইসব ফল-সব্জি ঘরে নিয়ে আসে। পাশের বাড়ির সঙ্গে গরু বাঁধা দড়ি এবং ফল-সব্জি অদল বদল করা হয়। ঘরে ঘর গিয়ে সবাই স্নান করে ‘নামঘরে’ গিয়ে গরুদের মঙ্গলের জন্যে প্রাৰ্থনা করে ভগবানের সামনে ‘শরাই’ অৰ্থাত প্ৰসাদ নিবেদন করে। এর পর পরম্পরা অনুযায়ী পরিবারের সবাই মিলে চিড়ে-দই খায় তাকে ‘জলপান’ বলা হয়। ‘নাহর’ পাতায় মন্ত্ৰ লিখে ঘরের দরজা-জানলা কোণায় লাগাতে হয়। প্রচলিত এই নিয়ম পালন করলে ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ভগবান শিবকে প্ৰাৰ্থনা জানিয়ে নাহর পাতার উলটো দিকে লেখা হয়-
দেব দেব মহাদেব নীলগ্ৰীব জটাধর।
বাত বৃষ্টি হরংদেব মহাদেব নমস্তুতে।।
দিনের শেষে গরুকে বাড়িতে আনার পর খড় জ্বালিয়ে পাখা দিয়ে গরুর সাড়া শরীরের দিগে দেওয়া হয়। অসমিয়ারা একে জাক দেওয়া বলে। গরুকে পাখা দিয়ে হাওড়া দেওয়ার পরেই অসমিয়ারা ওই পাখা ব্যবহার করে। অসমেৰ অনেক জা়য়গায় সন্ধ্যায় গরুকে গোয়াল ঘরে প্ৰবেশ করার আগে গরুর মাছের জল দিয়ে গৰুর পা- ধোয়ানো হয়। স্থানীয় লোকপ্রথা অনুসারে এমন করলে গরুকে কোনও ধরনে রোগ আক্রমণ করতে পারে না। চালের গুড় দিয়ে পিঠা বানিয়ে গরুকে খাওয়ানোর প্ৰথা এই গরু বিহুর অন্যতম রীতি। গরুকে বাধার নতুন দড়িকে পাট এবং তারা গাছের আঁশ দিয়ে বাানানো হয়। এই দড়ি দিয়ে গরুকে বাধার আগে তাতে হলুদের প্ৰলেপ দেওয়া হয়। এরপর গরুর গলায় নতুন দড়ি পরিয়ে তাকেও নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাতে হয়।
সপ্তমী দাস— এনকেটিভি বাংলার সোশ্যাল মিডিয়া এগজিকিউটিভ। সপ্তমীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা অসমের বুকে। অহমিয়া সংস্কৃতি ও উৎসব-আচার নিয়েও তাঁর রয়েছে বিশাল বুৎপত্তি।