পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই সেল দেওয়া হয় দোকানে দোকানে, এই সুযোগেই বাড়ির বিছানার চাদর থেকে মায় পর্দা পর্যন্ত বদলে নেয় বাঙালি, লিখছেন সুনন্দ আধিকারী
বাঙালি মাত্রই সে যেরকম আর্থিক অবস্থারই হোন না কেন। তার সাধ্য মতো সেদিন চেষ্টা করেন পরিবারের সবাই একটা নতুন বস্ত্র পরিধানের। একান্ত সবার জন্য সম্ভব না হলেও বাড়ির ছোটদের জন্য বরাদ্দ থাকে তা। ঠিক যেমন থাকে দুর্গাষষ্ঠীতেও।
‘নব আনন্দে জাগো; আজি’= সুনন্দ অধিকারী। কবে? চৈত্র মাসের শেষ দিন। মানে সংক্রান্তির রাত পেরনো পরের দিনের প্রথম রবি কিরণ যখন ভূমি স্পর্শ করছে সেই প্রভাতে। কেন? কেননা সেই দিন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর বাঙালির নতুন বছরের শুভারম্ভ। তার অতি প্রিয় পয়লা বৈশাখ। তাই নতুন আশা ভরসা বিশ্বাস ইত্যাদি সবরকম ইতিবাচকতার মধ্যে দিয়ে তাকে অনুভব। উৎসবের আবহে নতুন বছরে পদার্পণের উদ্যাপন তার।
এখানে ভূমি কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই পয়লা বৈশাখ পালনের শুরু আজ নয়। সম্রাট আকবরের সময় এর প্রচলন। বলা বাহুল্য সেই সময় কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। আর তখন এই নববর্ষ উদ্যাপিত হতো এক ঋতুউৎসব হিসেবেই।
আর কে না জানে কৃষির সঙ্গে ঋতুর সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে। আর তাই নববর্ষ জাতধর্ম ব্যতিরেকে এক সর্বজনীন লোকউৎসব।
তৎকালীন সময় তালুকদার জমিদার প্রভৃতি ঋণদাতাদের চৈত্রের শেষদিন পর্যন্ত খাজনা মেটাত কৃষকেরা। আর নববর্ষের দিন তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন ভূস্বামীরা। কালের নিয়মে সেই প্রথা আজ আর নেই বটে। কিন্তু আজও শহর গ্রামের দোকানে দোকানে ক্রেতারা তাদের সারাবছরের বাকি শোধ দেয় দোকানিদের। পরিবর্তে নতুন বছরে গণেশ পুজোর মধ্যে দিয়ে নতুন হিসেবের খাতা অর্থাৎ হালখাতা খোলেন তাঁরা। এবং সেইদিন মিষ্টিমুখ সরবত অধুনা কোল্ড ড্রিঙ্ক এবং নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ক্রেতাদের আপ্যায়িত করেন তাঁরা।
শুধু তাই নয়। বাঙালি মাত্রই সে যেরকম আর্থিক অবস্থারই হোন না কেন। তার সাধ্য মতো সেদিন চেষ্টা করেন পরিবারের সবাই একটা নতুন বস্ত্র পরিধানের। একান্ত সবার জন্য সম্ভব না হলেও বাড়ির ছোটদের জন্য বরাদ্দ থাকে তা। ঠিক যেমন থাকে দুর্গাষষ্ঠীতেও।
এই সময় এই পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই সেল দেওয়া হয় দোকানে দোকানে। কমবেশি মধ্যবিত্ত এই সুযোগেই বাড়ির বিছানার চাদর থেকে মায় পর্দা পর্যন্ত ইত্যাদি পরিবর্তনের কথা ভাবে এই নতুন বছরকে কেন্দ্রে রেখেই। মোটকথা নতুন বছরকে নতুন কিছুর মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানোর চেষ্টা তার একরকম বিশ্বাসও বটে। যার অর্থ বছরের বাকিদিনগুলোও তার মোটামুটি কমবেশি ভালোভাবেই কাটবে।
এইদিন কেবল দোকানে নয়। দক্ষিণেশ্বর থেকে কালীঘাট এবং পাড়ার মন্দিরে মন্দিরেও মানুষের ঢল নামে। ব্যবসায়ীরা হিসেবের নতুন খাতা কিনে সেই খাতা যেমন মায়ের পায়ে ছোঁয়াতে যান। তেমনি সাধারণ গৃহীরা সারাবছরের সাংসারিক মঙ্গল কামনায় পুজো দেন মন্দিরে। তারপর সেই প্রসাদ তুলে দেন পরিবারের লোকজনের মুখে। মাথায় ছোঁয়ান প্রসাদী ফুল।
যেহেতু সবই মানব হিতার্থে। তাই বর্তমান আবহে দাঁড়িয়ে এই নববর্ষে, মানে বাংলা ১৪৩১ বঙ্গাব্দের শুভক্ষণে দাঁড়িয়ে অবধারিত ভাবে আমাদের মনে উঁকি দিয়ে যায় কিছু প্রশ্ন। কিন্তু আজকের পৃথিবী কি ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে? সুদূর ইউক্রেন থেকে প্যালেস্টাইনের গাজা। যার একজায়গায় চলছে বৎসরকাল অধিক গড়িয়ে যাওয়া যুদ্ধ। অপর স্থানে একরকম প্রায় নরমেধ যজ্ঞ।
জানি এ প্রশ্ন উঠবে যে, বাংলা নববর্ষের কথা বলতে গিয়ে এই প্রসঙ্গ কেন? আসলে আজকের পৃথিবী সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া পৃথিবী। তাই সেখানে কেবল প্রতিবেশী নয়। সুদূর প্রতিবেশীও ভালো না থাকলে, সুস্থ না থাকলে, শান্তিতে না থাকলে, তার আঁচ আমাদের গায়েও পড়তে বাধ্য। তা আজ হোক অথবা কাল।
তাছাড়া, আরও একটা বড় তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার শুরু হতে চলেছে এই নববর্ষ মিটলেই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে। আর এইসব মিলিয়ে আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা নতুন বছরে শান্তি নেমে আসুক পৃথিবীর কোণে কোণে। ভারতবর্ষের নির্বাচনও যেন সমাপ্ত হয় একটাও প্রাণ না ঝরিয়ে। অলমিতি বিস্তরেণ।
শুভ্র ও সুন্দর। প্রীতি এবং উজ্জ্বল। নির্মল জীবন হোক সব মানুষের।
শুভ নববর্ষ।
ছবি পরিচয়– সুনন্দ অধিকারী, সাহিত্যিক