সুতির নতুন কড়কড়ে ফ্রক ভোরের গন্ধ হয়ে ডানা মেলত এ পাড়া ও পাড়ায়, পয়লা বৈশাখ এমন মায়ায় ভরা, লিখছেন অপর্ণা বিশ্বাস মজুমদার
‘কিছু কথা কিছু ব্যথা বাংলা নববর্ষ’— অপর্ণা বিশ্বাস মজুমদার। বাংলা নববর্ষ আসত রাজার মতো সোনার রথে চড়ে সমারোহে। আমাদের সাবেকি যৌথ পরিবারে ছোটবেলার পয়লা বৈশাখ এমন মায়ায় ভরা যে, চোখ বন্ধ করলেই তাকে ছুঁয়ে ফেলি! শেষ চৈত্রের সর্বনাশী পয়লা যেই না মিঠে কামড় বসিয়ে পালাত। অমনি সুতির নতুন কড়কড়ে ফ্রক ভোরের গন্ধ হয়ে ডানা মেলত এ পাড়া ও পাড়ায়।
তার আগে চৈত্রসেলে থিকথিকে হাতিবাগানে মা জেঠিমার অদম্য কেনাকাটা। ছাপা শাড়ি ধুতি-পাঞ্জাবি সুতির জামা পর্দার কাপড় বিছানার চাদর। যেন যুদ্ধ জয়ের আনন্দে বাড়ি ফিরত দুই জা। আর আমরা তুতো ভাইবোনেরা একসাথে হতাম তুমুল হুল্লোড়ে।
মোটে একদিন আগে গেছে নীলের পুজো। গাজন সন্ন্যাসীরা ফিরে গেছে মাধুকরী করে। সেও তো সেই বিকেলের গোধূলি আলোয়।
পাড়ার খুব চেনা তারা পিসি জগাজেঠু কাজ-টাজ ফেলে কেমন সন্ন্যাসী বনে যেত একমাস। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিত “বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে”। মা ভাঁড়ার ঘর থেকে এনে দিত চাল ডাল আনাজ মশলা পাতি। তারা পিসির কাজের ছুটি হয়ে যেত একমাস শুধু তারকনাথের কৃপায়।
দিনটা শুরু হতো খুব ভোরে। নতুন সূর্যোদয় দেখতে দেখতে পৌঁছে যেতাম দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মন্দিরে। বাবার ব্যবসার হালখাতা করতে। দেখতাম গঙ্গায় কত মানুষ ডুব দিচ্ছে ওই ভোরে। নদী বয়ে যেত ভিড়ে সকালের রোদ মেখে। শান্ত জলধারার ওপর ভেসে থাকতে দেখতাম বাংলার নতুন দিন। আমাদের পয়লা বৈশাখ।
তারপর শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধিকাল অবুঝ যৌবন বোশেখের প্রথম দিনটি এভাবেই আবেগে ভেসেছে সুখে অফুরান আনন্দে। মায়ের হাতের বাসন্তী পোলাও। পিসিমার রসমালাই। এমন মহার্ঘ খাবার। ভাইবোনেদের মিঠে খুনসুটি। দূরদর্শনে পঙ্কজ সাহার নববর্ষের বৈঠক। এই নিয়েই মোটামুটি আমাদের নব্বইয়ের নববর্ষ যাপন। এই অনুভূতি কমবেশি সবার।
বাংলা নববর্ষ একসময় বাঙালির অন্যতম বড় উৎসব একথা মানতে হবে। পুরনো কলকাতার বাবু সংস্কৃতির প্রবহমান শরীরে পয়লা বৈশাখ জাঁকজমকে আড়ম্বরে সকল জাতিকে টেক্কা দিয়েছে। নতুন বছরে আলোর রোশনাই খানাপিনা দান খয়রাত বাঈনাচ ফিরিঙ্গি অতিথিদের সমাগমে তথাকথিত বিখ্যাত পরিবারগুলোর রেষারেষিও দেখবার মতো ছিল। আর এই নববর্ষ বা বাংলা নতুন বছরের শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে। সেই সময় চৈত্রের শেষে প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় সম্পূর্ণ হলে গ্রামের জমিদাররা বছরের প্রথম দিনটিতে প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। সেই সঙ্গে আয়োজন করা হতো আনন্দানুষ্ঠানের।
সেই থেকে নববর্ষ বিভিন্ন সময়ে নানা রূপে থেকে গেছে বাঙালির শিরায় উপশিরায়। আমার নববর্ষ পুরাতনী গানের মতোই অচল এখন। পাড়ার দোকানে আর যাওয়া হয় না কতকাল। দোকানি কাকু জেঠুরা হয়তো বা নেই হয়ে গেছে। দূরদর্শনে কেউ আর নববর্ষের বৈঠক দ্যাখে না। আসলে কেউ আর দূরদর্শনই দ্যাখে না।
আমাদের সাবেকি বাড়িটা একেবারে ফাঁকা। ভাইবোনেরা ফেসবুকে থাকে। ভিডিয়ো কলে দ্যাখা হয়। নববর্ষে যে যার টেবিল বুক করে পরিবার নিয়ে। বাঙালি খাবার খায় দামি রেস্তোরাঁর ঠান্ডা ঘরে। হাতিবাগান নয়। আমরা এখন শপিং মলে চৈত্রের বাজার করি। বিকেলে কেউ ক্লাবে যায়। কেউ বা জলসায়। নববর্ষ মানে আর হুল্লোড় নয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা মোবাইলে ফান শেয়ার করে। তবু পয়লা বৈশাখ এলেই মোহর স্মৃতিগুলো ঝাঁপ খুলে বসে। যেন গত জন্মের সুখ পলাশের রঙে আবারও তাজা অমলিন হয়ে জেগে ওঠে গভীর অন্তরে।
ছবি পরিচয়- অপর্ণা বিশ্বাস মজুমদার, সাহিত্যিক