LokSabha Election 2024: একদিকে দেবাংশু অন্যদিকে সায়ন তমলুকে পদ্মকে ন্যায় দিতে পারবেন তো প্রাক্তন বিচারপতি
তমলুক লোকসভা কেন্দ্র। ২০২৪ সালে দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে বাংলার ৪২ কেন্দ্রের যেগুলিতে মানুষের বিশেষ চোখ রয়েছে তাঁর মধ্যে একটি হল তমলুক। কারণ অবশ্যই এই কেন্দ্রের দুই প্রার্থী বিজেপির অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য।
স্বাধীনতার আগে থেকেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন পূর্ব মেদিনীপুর। স্বাধীনতার পরে এই আসনে পর পর পাঁচ বার জয়ী হন কংগ্রেস প্রার্থী সতীশচন্দ্র সামন্ত। প্রথম তিন বার তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের এবং পরের দু’বার ভোটে লড়েন বাংলা কংগ্রেসের টিকিতে। ১৯৭৭ সালে তমলুকে জয় পায় মোরারজি দেশাইয়ের জনতা পার্টি।
এরপর ১৯৮০ সালে কায়েম হয় বাম রাজত্ব। পর পর চার বার সাংসদ হন সিপিআইয়ের সত্যগোপাল মিশ্র। তবে ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের জয়ন্ত ভট্টাচার্যের কাছে হেরে যান তিনি। কিন্তু ঠিক দু’বছর পরে ১৯৯৮ সালে ফের হারানো আসন পুনরুদ্ধার করে বামেরা। সাংসদ হন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা লক্ষণ শেঠ। টানা তিন বার জয়ী হন তিনি। ২০০৯ সালে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মমতার ছায়া সঙ্গী শুভেন্দুর কাছে হেরে যান লক্ষণ। প্রায় দু লক্ষ ভোটে জয়ী হয় তৃণমূলের প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারি। ঘাসফুল পায় ৫৫ শতাংশ ভোট। বামেরা পায় ৪০ শতাংশ ভোট। তখন বিজেপি প্রায় নেই বললেই চলে। ঝুলিতে মাত্র ১.৭৬ শতাংশ ভোট।
২০১৪ সালে আবারও তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয় শুভেন্দু। জয়ের ব্যবধান আরও বেড়ে হয় প্রায় পৌনে ৩ লক্ষ। দ্বিতীয় স্থানে বামেদের ঝুলিতে ভোট কমে হয় ৩৫ শতাংশ। বামেদের ৫ শতাংশ ভোট কমলেও বিজেপির ভোট বাড়ে। ১.৭৬ থেকে হয় ৬.৪০ শতাংশ। কিন্তু তবু লড়াইয়ে ময়দানে অনেক দূরে।
এরপর ২০১৬ সালে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন শুভেন্দু। মমতা তাঁকে বিধানসভায় নিয়ে এসে মন্ত্রী করেন। উপ নির্বাচনে তাঁর কথাতেই প্রার্থী করা হয় শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারীকে। জয়ের ব্যবধান ভোটের শতাংশ দুই বৃদ্ধি পায় তৃণমূলের। প্রায় ৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ভোটে জেতেন দিব্যেন্দু। ভোট বেড়ে হয় ৫৯ শতাংশ। তৃণমূলের সঙ্গেই এই নির্বাচনে এক লাফে ৯ শতাংশ ভোট বাড়ে বিজেপির। তারা পায় ১৫ শতাংশ ভোট। কিন্তু নজিরবিহীন ভাবে ভোট কমে বামেদের, মাত্র ২১ শতাংশ ভোট পায় তাঁরা।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আবারও দিব্যেন্দুকে প্রার্থী করে তৃণমূল। ভোটের ব্যবধান কমে। প্রায় দু’লাখ ভোটে জয় পায় সে। ৫৯ শতাংশ থেকে ভোট কমে আসে ৫০ শতাংশে। ততদিনে বামেদের ভোট অন্যদিকে ঘুরে গিয়েছে। শাসক দল অবশ্য বলে তা রামে থুরি বিজেপিতে গিয়েছে। যাই হোক মাত্র ৯ শতাংশ ভোট বামেরা হয় তৃতীয়। বামেদের ৩ বারের সাংসদ লক্ষণ শেঠ কংগ্রেসের ‘হাত’ ধরে মাত্র ১ শতাংশ ভোট পান। আর ৩৬.৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে মূল প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে বিজেপি।
তবে এখন অধিকারী পরিবারের সবাই ঘাসফুল ছেড়ে পদ্ম চাষে ব্যস্ত। প্রথমে মনে করা হয়েছিল এই বারে এই আসনে দিব্যেন্দুকে প্রার্থী করা হতে পারে। কিন্তু তাঁর বদলে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রার্থী করেছে পদ্ম শিবির। সেটাও ভোটের অঙ্ক কষে তারপরেই। কারণ এই কেন্দ্রেই রয়েছে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড়। তাই চাকরিপ্রার্থীদের ভোটকে টানতে বিজেপি অভিজিতকে প্রার্থী করেছে বলে দাবি রাজনীতির কারবারিদের। তবে প্রার্থী যেই হোক না কেন আসলে যে এই আসনে শুভেন্দুর উপরেই ভরসা তা বেশ ভালই জানেন শাসক-বিরোধী দুই পক্ষ।
তৃণমূল প্রার্থী করেছে দলের তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় দেবাংশু ভট্টাচার্যকে। প্রচারে গিয়ে দেবাংশু বলেন ‘আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আমার বয়স কম তাই বেশি দৌড়তে পারব। তমলুকের মানুষের কখা সাংসদে তুলে ধরব।’ আবার ভোটে জিতলে আরেক নতুন রেকর্ড গড়বেন তিনি। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে অমর হয়ে আছে ১৯৮৪ সালে যাদবপুর কেন্দ্রে বামেদে দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে ২৯ বছরের মমতা ব্যানার্জির ভোটে জিতে যাওয়া। এই জয়কে মমতার রাজনৈতিক উত্থানের অন্যতম প্রধান কান্ডারি বলে মেনে নেন অনেকে। আর এই ভোটে প্রার্থী তরুণ দেবাংশুর বর্তমান বয়স ২৮। অর্থাৎ জিতলে নিজের নেত্রীর থেকেও কম বয়সে সাংসদ হওয়ার নজির গড়বেন তিনি।
তমলুকে বামেদের ভরসা সেই জোয়ান চালে। প্রার্থী করেছে আইনজীবি সায়ন ব্যানার্জি। বামেদের নব ব্রিগেডের যে সব নেতারা সামনের সারিতে রয়েছে তাঁদের মধ্যে সায়ন অন্যতম। প্রথমদিন থেকে ঝড় তুলেছেন প্রচারে। দাবি এই ভোটে ম্যাজিক দেখাবে কাস্তে হাতুড়ি তারা।
তবে ভোটের অঙ্কের দিকে তাকালে অবশ্য তা খানিকটা অন্য কথা বলছে। হিসাব বলছে ৭ বিধানসভার মধ্যে ৪টি তমলুক, পাঁশকুড়া পূর্ব, নন্দকুমার এবং মহিষাদল রয়েছে তৃণমূলের দখলে। আবার হলদিয়া, ময়না এবং নন্দীগ্রাম রয়েছে বিজেপি দখলে। সেই দিক থেকে বামেদের হাত ফাঁকা। আবার ২০১৯ সালের বাম-কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট মেলালে তা হয় প্রায় ১১ শতাংশ মত। তাঁর মানে বামেদের সায়নের হাতে এখন সম্বল বলতে কেবল ১১ শতাংশ ভোট।
তবে রয়েছে আরও কিছু বিষয়। মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারের প্রভাব রয়েছে। ২০১৯ সালে ভোটে যার সুবিধা পেয়েছিল জোড়াফুল। তবে ২০২১ সালে ভোটের আগে সেই অঙ্ক বদলে যায়। যদিও তারপরেও ৪টি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল। কিন্তু নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে হারতে হয়েছিল খোদ মমতা ব্যানার্জিকে। যদিও তৃণমূলের দাবি শেষ বেলায় আল নিভিয়ে রিগিং করে ভোটে জিতেছিল শুভেন্দু। আবার বিচারপতির চেয়ার থেকে সোজা রাজনীতির ময়দানে ঝাঁপ দেওয়ায় বিজেপি প্রার্থীর সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। গোদের উপর বিষফোঁড়া মমতা প্রসঙ্গে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একের পর এক লাগাম ছাড়া আক্রমণ। যার জেরে ভোটের মুখে কমিশনের কোপে পরে ২৪ ঘন্টার জন্য ভোট প্রচার থেকে বিরত থাকতে হয়েছে প্রাক্তন বিচারপতিকে। তবে মানুষের মনে কে দাগ কাটবেন তা বলবে সময়।